কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের আয়োজনে রাজধানীর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) অডিটরিয়ামে নির্বিঘ্নে বোরো আবাদ: সতর্কতা ও করণীয় শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজিত এ কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি বলেন, স্বল্প জীবনকালীন বোরোর কোনো বিকল্প নাই। যদি স্বল্প জীবনকালীন বোরো কৃষকের হাতে দিতে পারেন তাহলে বোরো আরো অনেকদিন থাকবে। আর যদি তা না হয় কৃষক বোরো করবে না, জমি খালি রাখবে। অন্য কাজে ব্যবহার করবে। কৃষককে জোর করে কিছু করাতে পারবেন না।
মন্ত্রী বলেন, আমাদের বিজ্ঞানীদের এমন জাত উদ্ভাবন করতে হবে যা ব্রি২৮ এর মতো জীবনকাল, কিন্তু ফলন দিবে ব্রি২৯ এর মতো। তাহলে কৃষকরা বোরো উৎপাদনে উৎসাহিত হবে। তিনি আরও বলেন, একই জমিতে বারবার ধান উৎপাদনের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এতে রোগবালাই ও পোকার আক্রমণ কম হবে। এ ব্যাপারে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, বিপিএইচএর আক্রমন প্রতিরোধে আলোক ফাঁদের ব্যবহারে অপকারী পোকা ধ্বংস করা ও কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে উপকারী পোকা সংরক্ষণ করতে হবে। ধানে নতুনভাবে আসা ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে বিজ্ঞানী ও মাঠ কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে।
মন্ত্রী উল্লেখ করেন, আমাদের ভূগর্ভস্থ পানি অত্যন্ত দ্রুত হারে নেমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ডিপ টিউবওয়েল স্থাপনে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহার করে চাষাবাদের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ্র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় আরো বক্তব্য রাখেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল আজিজ ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. ভাগ্য রানী বণিক। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর ও পরিচালক (প্রশাসন) ড. মো. আনছার আলী কর্মশালায় দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব ড. এস এম নাজমুল ইসলাম। কর্মশালার সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মো. মোশারফ হোসেন।
চলতি বোরো মওসুমে নির্বিঘ্নে ফসল চাষের সুবিধার্থে যাবতীয় পরামর্শসহ বিস্তারিত তথ্যাদি এ কর্মশালায় উপস্থাপন করা হয়। কর্মশালায় বক্তরা বলেন, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয় এবং প্রাং ১৫.৫ মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন হয়। উফশী বোরো এলাকা প্রায় ৩.৯ মিলিয়ন হেক্টর। সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাঠ পর্যায়ে উফশী বোরো ধানের ফলন ৪.০ থেকে ৮.৫ টন/হেক্টর পর্যন্ত এবং গড় ফলন ৫টন/হেক্টর পাওয়া যায়। যথাযথ কৃষি তাত্বিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৫ থেকে ২.০ টন বাড়ানো সম্ভব যা জাতীয় উৎপাদনে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বোরো মৌসুমের উপযোগী ৩৫টি (৩১টি ইনব্রিড ও ৪টি হাইব্রিড) উফশী ধানের জাত এবং ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানা রকম কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
বক্তাগণ বলেন, দেশের প্রায় সব জেলায় কম বেশি বোরো চাষ হলেও উত্তরপূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকা বোরো চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। এসব এলাকায় বোরো চাষও বেশি হয়। হাওর এলাকায় নিম্নাঞ্চলে কেবলমাত্র একটি ফসল-বোরো ধান হয়। দেশের মোট চাল উৎপাদনের ৫৫ শতাংশ হয় বোরো মৌসুমে, যা সেচনির্ভর। চলতি বছর মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টি ও উজান থেকে ধেয়ে আসা অকাল বন্যায় বোরো ফসল ঘরে তোলার আগেই পানিতে তলিয়ে যায়। এবারের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল গত কয়েক বছরের তুলনায় দশগুণ বেশি (প্রায় ৬২৫ মিমি), যেটা এর আগের বছর ছিল মাত্র ২৬৫ মিমি প্রায়।
হাওরের বোরো ফসল সাধারণত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে কাটা শুরু হয় কিন্তু এবছর এপ্রিলের ১ম সপ্তাহে চৈতালি বন্যার পানি আগাম চলে আসায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন হাওরবাসী। হাওরের আরেকটি সমস্যা হলো ধানের ফুল আসা পর্যায়ে ঠান্ডার প্রকোপ। এর কারণে ধানে চিটা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। চৈতালি ঢল ও ঠান্ডাজনিত চিটা এড়াতে হলে মার্চের শেষ সপ্তাহেই বোরো কাটার টার্গেট নিয়ে চাষাবাদ শুরু করতে হবে। এই জন্য আমাদের প্রয়োজন ১৩০-১৩৫ দিনের জাত, যেটি হবে ফুল আসা পর্যায়ে ঠান্ডা সহনশীল। ব্রি ধান২৮, ব্র্রি ধান৩৫, ব্রি ধান৩৬ ও ব্রি ধান৪৫ এর গড় জীবনকাল ১৪০-১৪৫দিন। ১৫-২২ নভেম্বরের মধ্যে বীজতলা তৈরি করে ৩০ দিন বয়সী চারা রোপণ করতে হবে, এর বেশি বয়স্ক চারা ব্যবহার করা যাবে না। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে ১০ এপ্রিলের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। ব্যয় ও চাষে সময়কাল কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি, এবং আধুনিক কৃষিতে কৃষককে এগিয়ে নেওয়াসহ নির্বিঘ্নে বোরো আবাদে সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।